স্মৃতিতে ড. হুমায়ূন কবীর স্যার

প্রফেসর ড. হুমায়ূন কবীর (১৯৪৩ – ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭)

প্রফেসর ড. হুমায়ূন কবীর (১৯৪৩ – ডিসেম্বর ২৭, ২০১৭)

ড. হুমায়ূন কবীর স্যারের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক কিছুই মনে পড়ছে। কিন্তু ঠিক প্রথম পরিচয়ের কথাটি মনে পড়ছে না। স্যার আমাদের বেসিক স্ট্যাট কোর্সটি পড়াতেন।

হুমায়ুন কবীর স্যার এক কথায় এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। একাধারে গুরুজন, স্কলার, শিক্ষক, অভিভাবক, এবং সর্বোপরি মজার একজন মানুষ। আমরা প্রথম ব্যাচের ছাত্র বলে স্যার আমাদের প্রথম সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। নোয়াখালীর একসেন্টে আমাদের সাথে প্রায়ই লেখাপড়ার বাইরের অনেক কিছু নিয়ে আলাপ করতেন। এসবের মূল উদ্দেশ্য থাকতো ক্লাসে আনন্দ দেয়া এবং জীবন সম্পর্কিত এবং জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা শেয়ার করা।

আমরা যারা প্রথম ব্যাচের ছিলাম তারা ব্যতীত হয়তো অনেকেই জানে না যে আমাদের ব্যাচে শুরুতে কোন ছাত্রী ছিলনা। পরে তামান্না (ড. তামান্না হাওলাদার) আমাদের সাথে যোগ দেয়। কবীর স্যার আমাকে ডাকতেন বাবা-রহীম আর তামান্নাকে ডাকতেন মা-তামান্না বলে। স্যার কেন ওই বিশেষণে ডাকতেন তা ঠিক মনে নেই। তবে ধারণা করি স্যারের প্রথম এসাইনমেন্টে আমি খুব ভালো করেছিলাম। স্যার আমাদের একটি রিপোর্ট লিখতে দিয়েছিলেন। আমি এসব কাজে বরাবরই কনফিডেন্ট। নীলক্ষেত থেকে তিনটি বই কিনে কয়েকদিন ধরে সেগুলো পড়ে সেখান থেকে সামারি তৈরী করে সুন্দর করে হাতে লেখা রিপোর্ট জমা দিয়েছিলাম।

সেটি ১৯৯৫ সনের কথা। সে সময়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ছিল না বা থাকলেও গুটিকতকের নাগালে। ইমেইল সবে মাত্র চালু হয়েছিল, তাও সম্ভববত অফলাইন ইমেইল। বাংলা ডট নেট ওদের ভিস্যাট দিয়ে সিঙ্গাপুরের সাথে একটা যোগাযোগ স্থাপন করেছিল যার মাধ্যমে কেউ কেউ হয়তো ইমেইলের সুবিধা নিত। যাই হোক, ইন্টারনেট না থাকার কারণে আমাদের জন্য নীলক্ষেতই ছিল ভরসা। বাংলাদেশী অথরের একটি মাত্র ইংরেজী বই পাওয়া যেত। সেটি যোগাড় করে নীলক্ষেত থেকে দুটি (বা তার বেশীও হতে পারে মনে করতে পারছিনা) ভারতীয় লেখকের বই কিনে সেই এসাইনমেন্ট তৈরী করেছিলাম।

সেই এসাইনমেন্টে স্যার আমাকে “এক্সেলেন্ট” দিয়েছিলেন এবং সম্ভবত সেখান থেকেই স্যারের নজরে পড়ি। স্যার এভাবে ডাকতেন বলে নিজেকে বন্ধুদের মাঝে খ্যাতনামা মনে হতো। তবে সে খ্যাতির বিড়ম্বনাও ছিল। বাবা রহীম ডাকার কারণে মাঝে মাঝে বিব্রতবোধ করতাম বিশেষ করে ক্লাসে যখন কিছু জিজ্ঞেস করতেন আর সেটির উত্তর ঠিকমতো জানা থাকতো না। ভালবাসার চাপ যাকে বলে। তবে উত্তর ঠিক মতো না দিতে পারলে স্যার কখনো নাখোশ হতে না। বরং সেই উত্তরটি স্যার ক্লাসের সবাইকে তার মতো করে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন।

স্যারের অনেক কথা এখনও আমাদের স্পষ্ট মনে আছে। এবং আমি নিশ্চিত যারা স্যারের ক্লাস করছে তাদের সবারই এরকম স্মৃতি আছে। একবার স্যার আমাদের কী এক প্রসঙ্গে বলছেন স্যারের বিয়ের পরবর্তী একটি ঘটনা।

তাঁর এক আত্নীয় দোয়া করেছেন এই বলে যে– “তুমি একশ বাচ্চার বাবা হও”। স্যার মুখে একটা অবাক হওয়ার এক্সপ্রেশন দিয়ে অভিনয় করে আমাদের বলছেন–

“এইডা আপনি কী কইলেন? এটা তো দোয়া না, বদ দোয়া।”

এরপর স্যার তাঁর স্বভাবসুলভ নোয়াখালীর টোনে বলছেন–

“আমার আত্নীয়রা যখন ফোন করে খবর দেয় তাদের বাচ্চা হইছে, আমি কই বাচ্চা হইলে খবর দেওয়ার দরকার নাই, বরং গরুর বাচ্চা হইলে খবর দিও।”

আহা এসব কেবলই স্মৃতি। স্মৃতি হলেও খুবই সতেজ সেই স্মৃতি।

স্যার ইংরেজীতে খুবই ভাল লিখতেন। এটি আমরা সিনিয়র অন্য প্রফেসরদের কাছ থেকেই জেনেছি। আমরা অফিসিয়াল কিছু ইংরেজীতে লিখলে সেটি স্যারকে দিয়ে রিভিউ করিয়ে নিতাম।

আমার মনে পড়ছে স্যার আমাকে প্রায়ই তার রুমে নিয়ে বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতেন। আমি মাঝে মাঝে উসখুস করতাম, বোঝাতাম যে স্যার যেতে হবে। স্যার তাও নানা গল্প করতেন। একদিন সম্ভবত টিনের মধ্যে থেকে বিসকুট বের করে খেতেও দিয়েছিলেন। স্যার আমাদের অনেক স্নেহ করতেন।

স্যার ছিলেন নীতিবান একজন মানুষ। আদর্শ মানুষের গুনাবলী সবই স্যারের মাঝে ছিল এবং তিনি সেগুলোও আমাদের শেখাতেন তার স্বভাবসুলভ স্টাইলে। একদিন ক্লাসে কী প্রসঙ্গে মানুষ কেন খারপ হয়ে যাচ্ছে সেই নিয়ে কথা হচ্ছিল। এরপর স্যার যা বলেছিলেন সেটি এখনো আমি মনে করতে পারি। স্যার বলেছিলেন, “তোমরা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হও আর যাই হও, শিক্ষক হিসেবে (এই ইনস্টিটিউটে) যোগ দেয়ার জন্য আগে ভালো মানুষ হইতে হইব। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হইবা কিন্তু মানুষ হইবা না– নিমুনা।” কথাটি খুবই কমন কিন্তু খুবই গভীর। আমাদের নীতিকথা বলার মতো মানুষ আজকাল দেখা যায়না। আমি হাইস্কুলেও এরকম নীতিকথা শুনিনি। স্যার আমাদের অনেক কিছু দিয়ে গিয়েছেন যা সারাজীবন আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে।

স্যার ছিলেন অসম্ভব জেনারাস। আমাদের প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার পর (সময়টা ঠিক মনে নেই, ভুল হতে পারে) স্যার আমাদের ক্যাফে ঝিলে খাইয়েছিলেন। তখন ক্যাফে ঝিল ছিল প্রেসক্লাবের উল্টো দিকে। এখন সেখানে আছে কিনা জানি না। তবে এই ঘটনা আমাদের জন্য চির স্মরনীয় হয়ে আছে। তখন ছাত্র হিসেবে ক্যাফে ঝিলে খাওয়া একটা বিশাল ব্যাপার ছিল।

২০০৫ সনে কানাডা থেকে দেশে বেড়াতে গিয়ে স্যারের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল। স্যার আবারও আমাকে তার অফিসে ডেকে নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। স্যার বলেছিলেন একই ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স আর পিএইচডি না করতে। কারণ এতে নাকি অভিজ্ঞতা অর্জন ঠিকমতো হয়না। আমি স্যারের সেই কথা এখন আমার ছাত্রদের বলি এবং আমিও সেটি বিশ্বাস করি। স্যার আমাদের কত কিছু শিখিয়েছেন! মাঝখানে স্যারের অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

২০১৪’র ডিসেম্বরে দেশে গিয়ে স্যারের সাথে দেখা করার সুযোগ হয়নি কারণ আমি নিজেই অসুস্হ হয়ে পড়ে ছিলাম। এরপর ২০১৭’র ডিসেম্বরে আব্বার সাথে শেষ দেখা করতে গিয়েও স্যারের সাথে দেখা হলনা। ফিরে আসার পরে প্রথমে আব্বার এবং তার এক সপ্তাহ পরে স্যারের ইন্তেকালের খবর পেলাম। আমার জন্য শোকের উপর শোক। স্যারও মিরপুরে থাকতেন এটা আমি ঠিক জানতাম না। পরে আফসোস করেছি আহা কেন স্যারকে এক নজর দেখে আসলাম না। এই আফসোস আমাকের বাকী জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আজ স্যারের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বুকটা ভারী হয়ে উঠল।

শিক্ষক হিসেবে উনি আমাদের এত কিছু দিয়েছেন যে তার সব ছাত্র-ছাত্রী এক বাক্যে স্বীকার করবে। উনি নিঃস্বার্থভাবে আমাদের দিয়েছেন। শিখিয়েছেন তাঁর জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে। তাঁর মধ্যে কোন মেকী ছিলনা। যা বিশ্বাস করতেন তা আমাদের সাথে শেয়ার করতেন। স্যার এক কথায় চমৎকার একজন মানুষ ছিলেন। যারা স্যারের সংস্পর্শে এসেছে তাদের কাছে স্যার স্মরনীয় থাকবেন। রাব্বুল আ’লামীনের কাছে স্যারের জন্য অনেক দোয়া করি যেন উনি আখারাতেও সম্মানিত হন।

ছবি: ২৭ জুলাই ২০০৫ (লেখকের তোলা)

Categories: Blog
Tags:
comments powered by Disqus