প‍্যাশন, প্রফেশনালিজম, ও প্রায়োরিটি

Table of Contents

কর্পোরেট জগতে ডেটা নিয়ে যারা কাজ করে– যেমন পরিসংখ্যানবিদ, ডেটা সায়েন্টিস্ট– তাদেরকে অধিকাংশ সময় মাল্টিটাস্ক করতে হয় এবং একই সময় অনেক ক্লায়েন্টদের সাথে ডিল করতে হয়। ক্লায়েন্ট হতে পারে ইন্টারনাল ডিপার্টমেন্টাল ক্লায়েন্ট কিংবা কখনো কখনো এক্সটারনাল। ডেটা নিয়ে কাজ করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনালি পরিসংখ্যানবিদ ও ডেটা সায়েন্টিস্টদের চাহিদা অনেক বেশি। কর্মক্ষেত্রে পরিসংখ্যানবিদ ও ডেটা সায়েন্টিস্টদের তিনটি বিষয়ে অবগত করতে এই আর্টিকেল।

পরিসংখ‍্যানবিদদের ভূমিকা

আমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলিতে পরিসংখ‍্যানবিদদের তাদের কাজের কারণে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ এসব দেশে পরিসংখ্যানবিদদের প্রফেশনাল ভ্যালু আছে। ব‍্যাপারটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে বোঝা সহজ নয়।

উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে।

বাংলাদেশে অনেক চাকুরীতে পরিসংখ‍্যানবিদ একটি যোগ্যতা হিসেবে চাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে পরিসংখ‍্যানের কী ধরনের কাজ থাকে বা পরিসংখ্যানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষিত কেউ যখন সেই চাকুরীতে প্রবেশ করে তখন তিনি অর্জিত জ্ঞানের কতটুকু ব‍্যবহার করতে পারেন সে সম্পর্কে আমার যা ধারণা রয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় অল্পকিছু ব‍্যাতিরেকে বাংলাদেশে অধিকাংশ কর্মক্ষেত্রে পরিসংখ‍্যানবিদ হিসেবে পরিসংখ‍্যানের ছাত্র/ছাত্রীদের অংশগ্রহণ সীমিত।

এর মূল কারণ–পরিসংখ্যান অপরিচিত একটি বিষয়– তা নয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহুবছর ধরে পরিসংখ্যান পড়ানো হচ্ছে এবং বছর বছর একটা বড় সংখ্যক ছাত্র/ছাত্রী গ্রাজুয়েশন করছে।

বরং মূল কারণটি হল দেশে বিশেষভাবে দক্ষ এই গ্রাজুয়েটদের চাকুরীর ক্ষেত্র তৈরী হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয় কারণটি হলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সে অর্থে পরিসংখ্যানের মূল্য দীর্ঘদিন অনুধাবন করতে পারেনি। এমনকি সরকারি কর্মসংস্থানে পরিসংখ্যানবিদদের জন্য নির্ধারিত চাকুরীতেও পরিসংখ্যানবিদদের অংশগ্রহণ কেবলমাত্র গুটিকতক জরীপ কর্মকান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে

এই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলানো শুরু করেছে। বিশেষ করে দেশে টেলিকমিউনিকেশনের প্রসার এবং গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের দৈনন্দিন অনেক কাজকর্মে ইন্টারনেটের উপর নির্ভরতা বাড়ার ফলে এখন ডেটা ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগীতা কিছু কিছু সেক্টরে অনুভব করা শুরু হয়েছে।

সেই সাথে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে, বিশেষ করে টেলিকমিউনিকেশনে, এখন পরিসংখ্যানবিদদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। শুধু পরিসংখ্যানবিদ নয়, ডেটা নিয়ে যারাই কাজ করতে পারে তাদেরই এসব প্রতিষ্ঠানে কদর বাড়ছে। এই কদর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে বলে ধারণা করা যায়।

ইদানীং বাংলাদেশে স্টারটাপ কোম্পানী খোলার হিড়িক পড়েছে। যার মানে করা যায় এভাবে যে তরুণ সমাজ এখন চাকুরীর উপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেই উদ্যোক্তা হিসেবে আত্নপ্রকাশ করছে।

এর দুটি দিক রয়েছে– একটি হলো দেশে উদ্যোক্তাদের নতুন উদ্যোগ নিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি দিক হলো তরুণরাও এসব স্টারটাপ প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। প্রথম কারণটি বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন দক্ষ তরুণ জনগোষ্ঠী, যেটি দ্বিতীয় কারণটিকে ত্বরান্বিত করছে।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ডক্টরলা (doctorola.com) এবং পাঠাও (pathao.com) এর কথা। ডক্টরলা একটি বাংলাদেশী টেক স্টার্টআপ যেটির মাধ্যেমে রোগীরা ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করতে পারেন। আর পাঠাও হচ্ছে উবারের (uber.com) মতো রাইড সার্ভিস যেখানে যাত্রীরা মোবাইল এ্যাপের মাধ্যমে তাদের রাইড হায়ার করতে পারেন।

এসব স্টার্টআপ কোম্পানীতে কাজ করছে মূলত তরুণ উদ্যোক্তা ও সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েটরা। এ ধরনের স্টার্টআপ যত প্রসার লাভ করবে, ততই ডেটা প্রফেশনালদের কদর বাড়বে। সেখানে পরিসংখ্যান জানা দক্ষ প্রোগ্রামার ও ডেটা সাইন্টিস্টদের কাজের সুযোগ হবে।

প‍্যাশন

ডেটা প্রফেশনালরা তাদের কাজের প্রতি প্যাশনেট থাকে। তারা কাজ ভালোবাসে। তারা ডেটা থেকে অজানা তথ্য বের করে আনে যা ব্যবসায় এনে দেয় কম্পিটিটিভ এডভান্টেজ। সেই তথ্যর উপর নির্ভর করে সিইও-রা নতুন সিদ্ধান্ত ননেন স্ট্যাটেজির পরিবর্তন করেন। ডেটা থেকে প্রাপ্ত তথ্যই প্রকারান্তরে ব্যবসাকে এগিয়ে নেয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

পরিসংখ্যানবিদরা ডেটা প্রফেশনালদের মধ্যে একটি ভিন্ন ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন গ্রুপ যারা কেবল ডেটা প্রসেসিংই নয়, সেখান থেকে হাইপোথিসিস জেনারেশন, হাইপোথিসিস টেস্ট এবং প্রাপ্ত ডেটা থেকে তথ্য নিয়ে কীভাবে পুরো জনগোষ্ঠীর উপর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে সেই বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ।

প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা এই কারণে উল্লেখ করছি যে এই দক্ষতা অর্জনের একটি ধাপ হলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও কেউ স্বউদ্যোগেও পরিসংখ্যান শিখতে পারে এবং সফলভাবে তার ব্যবহার করতে পারে। যদিও তেমনটি সচারচর দেখা যায় না।

ডেটা নিয়ে কাজ করার বিশেষ দক্ষতার কারণেই উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে আমেরিকা, কানাডা, ইউকে এবং অস্ট্রেলিয়াতে পরিসংখ্যানবিদের চাহিদা ব্যাপক। হালে ডেটা সায়েন্সের ব্যাপক জোয়ারের মাঝে কম্পিউটার সায়েন্টিস্টদের সাথে সাথে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংএ দক্ষ পরিসংখ্যানবিদদের চাহিদা অনেক বেড়েছে। আইবিএম-এর প্রেডিকশন অনুযায়ি দক্ষ ডেটা সায়েন্টিস্টদের চাহিদা ২০২০ সালের মধ্যে ২৮% বাড়বে। 1

পরিসংখ্যানবিদ ও ডেটা সায়েন্টিস্টরা তাদের কাজের ব্যাপারে প্যাশনেট কারণ তারা তাদের অবদানের ইমপ্যাক্ট সরাসরি দেখতে পায়। তাদের তৈরী করা ডেটা সামারি দিয়েই সিইও-রা বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের তৈরী করা মডেল দিয়ে ব্যবসায়ের পরবর্তী পদক্ষেপটি নেয়া হয়। তাদের টেস্ট করা হাইপোথিসিসের উপর ভিত্তি করেই একটি নতুন প্রসেস চালু করা কিংবা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রসেসে পরিবর্তন আনা হয়।

অর্থাৎ পরিসংখ্যানবিদদের কাজের উপর নির্ভর করে অনেক বড় বড় কর্পোরেট সিদ্ধান্ত। যে কারণে প্রায় সময়ই কোন প্রতিষ্ঠানে পরিসংখ্যানবিদদের নানা ডিপার্টমেন্টের কাজে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। বিশেষ করে যদি সেই ডিপার্টমেন্টে স্বল্প সংক্ষক পরিসংখ্যানবিদ থাকে।

প্রফেশনালিজম

আর সেখানেই প্রফেশনালিজমের ব্যাপারটি চলে আসে।

আমরা, মানে পরিসংখ্যানবিদরা, অনেক সময় ডাক পড়লেই গিয়ে হাজির হই। আমরা বুঝি আমাদের মতামতের গুরুত্ব অনেক বেশী। আমরা বুঝি যে আমাদের এনালাইজ করা রেজাল্ট দিয়ে তাদের পরবর্তী ধাপ পূরণ হবে। আমাদের অপেক্ষায় তাদের কাজ আটকে থাকে। ফলে অনেক সময় না বুঝে অনেক অনুরোধে আমরা “হ্যাঁ বলে ফেলি। এতে করে পরিস্থিতি এমন হয় যাকে বলে too many things on the plate.

এই পরিস্থিতি সুস্থ কাজের পরিবেশের অন্তরায়।

এরকম পরিস্থিতিতে যাতে না পড়তে হয় সেজন্য সবসময় মনে রাখতে হবে যে আপনি একসাথে অল্প সংখ্যক কাজই ভালোভাবে সম্পন্ন করতে পারবেন। এজন্য সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত হলো অল্পকিছু কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে গুরুত্ব দিয়ে ফোকাস দেয়া করা। এখন অগুরুত্বপূর্ণ কিংবা পরে করলেও চলবে সেরকম কাজ আপাতত সরিয়ে রাখা।

প্রশ্ন হলো কীভাবে অনেকগুলো কাজের মধ্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোকে বাছাই করা যায়?

প্রায়োরিটি

যারা কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড-এ কাজ করে তারা একটি শব্দের সাথে পরিচিতি– সেটি হলো প্রায়োরিটাইজেশন (prioritization). অর্থাৎ অনেকগুলো কাজের মধ্যে থেকে কোন কাজটি বা কাজগুলোতে আপানাকে এই মুহূর্তে সময় দিতে হবে সেটি বাছাইয়ের প্রকৃয়া।

এই দক্ষতা একদিনে অর্জন করা যায় না। সময় নিয়ে, অভিজ্ঞা বাড়লে, সর্বোপরি প্রতষ্ঠান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা হলে প্রায়োরিটাইজ করা সহজ হয়।

আপনি কোন একটি দিনে যে কাজগুলো করবেন তার একটি তালিকা আপনার হাতে থাকবে। আপনি নিজেও এরকম একটি তালিকা তৈরী করতে পারেন। সেটি আপনার টাস্ক লিস্টে থাকতে পারে, কিংবা হাতে লেখা টু-ডু লিস্টেও হতে পারে।

সেরকম একটি তালিকা ধরে ধরে আপনি দিনের কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু সকাল ১০-টায় দেখা গেল আপনার ক্লায়েন্ট আরেকটি স্পেশাল রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা একটি কাজে হাত দেয়ার জন্য।

এখন আপনি কী করবেন?

এর কোন নির্দিষ্ট উত্তর নেই। কিংবা কোন একটি উত্তরও সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

আপনি এসব ক্ষেত্রে যা করতে পারেন সেটি হলো (কোম্পানি সম্পর্কে অভিজ্ঞতার আলোকে) আপনি বোঝার চেষ্টা করবেন রিকোয়েস্টটি আসলে যত গুরুত্বপূর্ণ দাবী করা হচ্ছে ততটা গুরুত্বপূর্ণ কিনা। সেটি বোঝার একটি উপায় হলো রিকোয়েস্ট যে পাঠিয়েছে তার সাথে কমিউনিকেট করা। করে বোঝার চেষ্টা করা এই রিকোয়েস্টটির বেনিফিশিয়ারি কে। বেনিফিশিয়ারি যদি আপনার বসের বস হয় যিনি একই দিনে বিকেলে একটা মিটিংয়ে এই রেজাল্ট প্রেজেন্ট করবেন সেক্ষেত্রে কাজটি হাই প্রায়োরিটি

অনেক সময় দেখা যায় কাজটির আসল বেনিফিশিয়ারি যে রিকোয়েস্টটি পাঠিয়েছে সে নিজে। এবং তার সাথে কথা বলে আরোও জানা গেলে যে এটি আসলে ততটা আর্জেন্ট নয় যতটা দাবী করা হয়েছিল। কমিউনিকেশনের মাধ্যেমেই আপনি সেই ব্যক্তিকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিবেন যে আপনার হাতের কাজগুলো শেষ করে তারপর ওনার কাজটা ধরবেন।

অনেক সময় নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে আপনি যে ডিপার্টমেন্ট থেকে রিকোয়েস্টটি এসেছে সেখানকার উপরের লেভেলের কারোও সাথে কানেক্ট করে কাজটির আর্জেন্সি বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে।

আপনি যদি জুনিয়র লেভেলের হন, তাহলে প্রথমেই আপনার ম্যানেজারের পরামর্শ নিতে পারেন। শুরুর দিকে ম্যানেজার আপনাকে সাহায্য করবে। পরে হয়তো আপনাকেই সেটি রপ্ত করতে হবে।

শেষ কথা

ডেটা নিয়ে ইদানীং তরুণদের অনেকেই কাজ করতে আগ্রহী হচ্ছে। একসময় এদের অনেকেই কর্পোরেট জগতে বড় বড় টিমের সাথে কাজ করবে। এবং ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে তারা অবধারিতভাবেই এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হবে। এসব নিয়ে আগে থেকে অবগত ও প্রস্তত থাকলে নিজেকে নতুন পরিবেশে দ্রুত মানিয়ে নেয়া সহজ হবে। ফলে কাজ কর্মে গতি আসবে এবং ম্যানেজার ও উপরের লেভেলের বসদের নজরে আসাও সহজ হবে। সর্বোপরি কাজ করে পরিতৃপ্তি আসবে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে তখন আরও ভালো লাগবে।

comments powered by Disqus